বলার অপেক্ষা রাখে না, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের যুগে বস্তুগত সংস্কৃতি ভারতের দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
ভারত বরাবরই সভ্যতা নির্ভর একটি রাষ্ট্র। ইতিহাসের পাতায় তাকালেও আমরা প্রাচীন সভ্যতা হতে অদ্যবধি ভারতকে একটি সভ্য আধুনিক মনস্ক সু-জাতি হিসেবেই পাই। সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে আদিকাল থেকে বর্তমানেও বহমান ভারতীয় সংস্কৃতি; যা পৃথিবীর অন্য অনেক সভ্যতার তুলনায় যথেষ্ট সমৃদ্ধ। ভারতের নমনীয় ও আকর্ষণীয় সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য নিজ গুণেই অত্র অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে স্থান করে নিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। আর এ বিষয়টি আধুনিক ভারত সরকারও অবগত। তাই, ‘সংস্কৃতি’ বরাবরই ভারতীয় কূটনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। বলার অপেক্ষা রাখে না, সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের যুগে বস্তুগত সংস্কৃতি ভারতের দ্বিপাক্ষিক কূটনীতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে নজর রাখলেও দেখা যাবে, ভগবান বুদ্ধের সংরক্ষিত স্মৃতিচিহ্ন থাইল্যান্ডে পাঠিয়েছিলো ভারত সরকার। আবার, রানি সেন্ট কেতেভানের স্মৃতিচিহ্নকে জর্জিয়ার হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনাও আদতে ভারতের সাংস্কৃতিক কূটনীতি এবং আন্ত-সাংস্কৃতিক সংযোগকে দর্শায়। তাই বলা বাহুল্য, ভারত নিজের চারপাশে, বিশেষ করে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে স্বীয় সংস্কৃতির প্রভাব দ্বারা ফায়দা নিতে চাইবে। তেমনই একটি অঞ্চল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বা আসিয়ান, যা বর্তমান সময়ে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য হাব।
ধারণা করা হয়, খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে ভারতীয় সংস্কৃতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। এই অঞ্চলগুলিতে ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তারকে ‘ভারতীয়করণ’ -এর নাম দেয়া হয়েছিল। শব্দটি ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিক, জর্জ কোয়েডস তার রচনা—সুদূর প্রাচ্যের হিন্দু রাজ্যগুলির প্রাচীন ইতিহাস- এ প্রথম উল্লেখ করেছিলেন। তিনি এটিকে একটি সংগঠিত সংস্কৃতির সম্প্রসারণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যা ভারতীয় রাজকীয়, হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্ম এবং সংস্কৃত ভাষাপ্রভাবের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বৃহত্তর ভারতের একটি অংশ হয়ে ওঠার প্রভাবে বহু সংখ্যক জাতির উদ্ভব হয় ও বিশ্বজুড়ে এই সাংস্কৃতিক বিস্তার হয়। তারই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ভারতের সংস্কৃতকরণ হয়, ভারতীয়কৃত রাজ্যের উত্থান হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দুধর্মের বিস্তার এবং বৌদ্ধ ধর্মের রেশম পথের দ্বারা সম্প্রসারণ ঘটে।
মালয়, থাই, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশীয় অঞ্চলে ভারতীয় সংস্কৃতি সাদরে গৃহীত হয়েছিল। ভারতীয় প্রবাসী, ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয়-বংশোদ্ভূত ব্যক্তি এবং বর্তমানকালে এনআরআই বা অনাবাসী ভারতীয়রা ভূ-রাজনৈতিক, কৌশলগত, বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং অর্থনৈতিক দিকগুলির পরিপ্রেক্ষিতে এই অঞ্চলে একটি চলমান মূল ভূমিকা পালন করেন।
বেশিরভাগ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় বিশাল সংখ্যক জাতিগত চীনা সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক ভারতীয় সম্প্রদায়ও বিদ্যমান। কিছুদিন আগেই চীনের সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান রেষারেষির মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ‘আসিয়ান’ দেশগুলোয় ভারতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
এতে আরও বলা হয়, সিঙ্গাপুরের আইএসইএএস-ইউসোফ ইসহাক ইনস্টিটিউটের জরিপে দেখা গেছে—অ্যাসোসিয়েশন অব সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনসের (আসিয়ান) ১০ সদস্য দেশের মধ্যে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ভারতের অবস্থান তৃতীয়তে।
এই দেশগুলোর নাগরিকরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাপানের পর ভারতকে বেশি পছন্দ করেন। প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২ সালের তুলনায় এ বছর ভারতের জনপ্রিয়তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। অর্থাৎ, গত বছরের ৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে বেড়ে তা ১১ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। ৬ দেশ নিয়ে চালানো জরিপে ভারতের পেছনে আছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের (ইউএসআইপি) দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড্যানিয়েল মার্কি সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, 'এই জরিপ থেকে যা পাওয়া গেছে তা আরও অর্থবহ হবে যদি ভারতের প্রতি সমর্থন পরবর্তীতে আরও বেড়ে যায়।'
প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বমঞ্চে আর্থ-রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি এই বছরটি ভারতের বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, বিশ্বের বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে তাদের কারখানাগুলো সরিয়ে ভারতে আনার সম্ভাবনা আছে। মহাকাশ গবেষণায় ভারত বেশ এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্ব সত্ত্বেও ভারত প্রথমবারের মতো মহাশূন্যে মানুষ পাঠাতে কাজ করছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের যোগাযোগ কয়েক হাজার বছরের পুরনো। সেই অঞ্চলের জাতিগুলোর ধর্মীয়-সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে ভারতীয়দের প্রভাব সুগভীর। আধুনিক ভারত রাষ্ট্রের পূর্বে বার্মা (মিয়ানমার) থেকে আরও পূর্বে ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ-পূর্বে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া হয়ে ফিলিপাইন পর্যন্ত দিল্লির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
সমালোচকদের অনেকে ভারতের দারিদ্র্য, দুর্বল পরিষেবা, অনুন্নত অবকাঠামো, রাজনৈতিক বিভেদ, সামাজিক বৈষম্য, প্রাদেশিক টানাপোড়েনসহ নানান বিষয়কে সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এসবের গুরুত্ব কতটুকু তা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে মুক্তির পর ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থানের ক্রমাগত উন্নতি করে চলেছে। বিশ্লেষক ক্লদিয়া চাইয়ের মতে, যেহেতু অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসিয়ান দেশগুলো হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করে না, তাই ধর্মীয় ও জাতিগত উত্তেজনার মতো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে তাদের আগ্রহ কম। এমনকি, এসব কারণে আসিয়ান দেশগুলোর কাছে ভারতের সম্মান হয়তো কমাবে না বলেও মনে করেন তিনি।
স্টকহোম সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান অ্যান্ড ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের প্রধান জগন্নাথ পান্ডা গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো ভারতকে বিদ্যমান বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের ক্ষেত্রে চীনের বিকল্প হিসেবে দেখছে।'
তার মতে, এখন ভারতকে দ্রুত এর অভ্যন্তরীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন ও বিনিয়োগবান্ধব আইন তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর এমন চাওয়াকে ‘বাস্তবসম্মত’ বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। গতবছরই দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল জানায়, চীনের সরবরাহ চেইনের বিকল্প হিসেবে ভারতের দিকে ঝুঁকছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে, বাইডেন প্রশাসন চীন ও অন্যান্য দেশ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি সরবরাহ চেইন সরিয়ে নিতে ভারতের সহায়তা চাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের আশঙ্কা, সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ সমস্যা সমাধানে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লি নিয়মিত বৈঠক করছে। হোয়াইট হাউস চাচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থেকে বেইজিংকে বিচ্ছিন্ন করে চীনা সেনাবাহিনীর উন্নয়নের গতি ধীর করে দিতে।
তাই, মানতেই হবে ভারত চাইলে অত্র অঞ্চলে নিজ প্রভাব বিস্তার পূর্বক একটি সুন্দর অঞ্চল গঠনে নেতৃত্ব দিতে পারে, যা আদতে বিশ্ব মানবতারই উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম। লেখাটি প্রথম ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক -এ প্রকাশিত হয়েছিলো